নকশী কাঁথার যতকথা

 



আপনি যদি একজন বাঙ্গালী হয়ে থাকেন তাহলে একটু খেয়াল করে দেখবেন যে আপনার মা বাসায় কোনো না কোনো একটি নকশী কাঁথা সংগ্রহ করে রেখেছে। গ্রাম বাংলার লোকশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন হলো এই কাঁথা। যার প্রচলন দেখা যায় বিশেষ করে উপমহাদেশের ভারত বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নানান রকম লোককথা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, গ্রাম বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইত্যাদি জিনিস বাহারি রঙ্গের সুতো দিয়ে নকশা করে বানানো হয় এই কাঁথা। সুই সুতোর চোখ ধাধানো নিপুণ কারুকার্যে গ্রামের কন্যা বধূরা এই কাঁথায় ফুটিয়ে তুলেন নান্দনিক নকশা শিল্প। অবশ্য গ্রামাঞ্চলগুলো এখন আধুনিকতার সংস্পর্শে এসে এই শিল্প প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। 

বেশিরভাগ গ্রামের নারী এই শিল্পে দক্ষ। সাধারণত গ্রামের মহিলারা তাদের অবসর সময় নকশি কাঁথা সেলাই করে থাকেন। এক একটি কাঁথা সেলাই করতে অনেক সময়, এমনকি ১ বছর সময়ও লেগে যায়। নতুন জামাইকে বা নাদ বউকে উপহার দেয়ার জন্য নানী-দাদীরা নকশি কাঁথা সেলাই করে থাকেন। এক একটি কাঁথা সেলাইয়ের পিছনে অনেক হাসি-কান্নার কাহিনী থাকে। বিকেল বেলা বা রাতের খাবারের পর মহিলারা একসাথে বসে গল্প করতে করতে এক একটি কাঁথা সেলাই করেন। তাই বলা হয় নকশি কাঁথা এক একজনের মনের কথা বলে। এটি মূলত বর্ষাকালে সেলাই করা হয়। একটা প্রমাণ মাপের কাঁথা তৈরিতে ৫থেকে ৭ টা শাড়ী দরকার হয়। আজকাল পুরাতন সামগ্রীর বদলে সূতির কাপর ব্যবহার করা হয়। ইদানীং কাঁথা তৈরিতে পুরাতন কাপড়ের ব্যবহার কমে গেছে।

বাংলা সাহিত্যে নকশী কাথা


'বিয়ের পরে রুপাই আর সাজুর ভালোবাসায় আখ্যান বেশি দূর যেতে পারেনি। ফেরারি হয়ে যায় রুপাই। স্বামীর অপেক্ষায় স্ত্রী সাজু বাকি জীবন নকশী কাঁথা বুনতে শুরু করে, দিন-মাস-বছর যায়। সাজু নকশী কাঁথায় সুঁইয়ের আচড় দিয়ে যায়, রুপাই ফিরে আসে না। সারা জীবন সাজুর এভাবেই কেটে যায়। নকশী কাঁথা বোনা যেদিন শেষ হয়ে যায় সেদিন সে মাকে অনুরোধ করে, তার মৃত্যুর পর যেন কবরের উপরে নকশী কাঁথাটি বিছিয়ে দেওয়া হয়। বহুদিন পরে নকশী কাঁথার নিচে শুয়ে থাকা সাজুর কবরের পাশে ভিনদেশী বংশীবাদকের মরদেহ পাওয়া যায়।'  [সংগ্রহ- নকশী কাঁথার মাঠ]

বলছিলাম পল্লিকবি জসীম উদ্দিনের লেখা নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যের কথা। নকশী কাঁথাকে কত আবেদনয়ী করে তুলেছেন কবি তার ভাষায়। যা বাংলা সাহিত্যে বিরল। 

কাঁথা তৈরীর উপকরণ


মূলত পাতলা কাপড়, প্রধানত পুরানো কাপড় স্তরে স্তরে সজ্জিত করে সেলাই করে কাঁথা তৈরি করা হয়। কাঁথা মিতব্যয়ীতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ, এখানে একাধিক পুরানো জিনিস একত্রিত করে নতুন একটি প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করা হয়। কাঁথা তৈরির কাজে পুরানো শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী কাঁথার পুরুত্ব কম বা বেশি হয়। পুরুত্ব অনুসারে তিন থেকে সাতটি শাড়ি স্তরে স্তরে সাজিয়ে নিয়ে স্তরগুলোকে সেলাইয়ের মাধ্যমে জুড়ে দিয়ে কাঁথা তৈরি করা হয়।

কাঁথার নকশা


তবে কাঁথায় হরহামেশা নকশা দেখা যায় যেমন ফুল, পাখি, লতাপাতা ইত্যাদি। পারিবারিকভাবে মা কিংবা দাদীর করা নকশার অনুকরণ করেন অনেকেই। গল্প, লোককথা, গ্রামীণ পুঁথির চরিত্র কিংবা ধর্মীয় চরিত্র আর অনুশাসন কাঁথার নকশায় আনে অনন্য এক বৈচিত্র। মূলত নকশা করার পূর্বে কোন কিছু দিয়ে এঁকে নেওয়া হয়। তারপর সুঁই-সুতা দিয়ে ওই আঁকা বরাবর সেলাই করা হয়। কাঁথায় সাধারণত মধ্যের অংশের নকশা আগে করা হয় এবং ধীরে ধীরে চারপাশের নকশা করা হয়। আগে কিছু কাঁথার নকশা আঁকানোর জন্য কাঠের ব্লক ব্যবহার করা হত, এখন ট্রেসিং পেপার ব্যবহার করা হয়। ধরণ অনুযায়ী অনেক প্রকার নকশার মধ্যে রয়েছেঃ 
পর্বত নকশা,           পাঞ্জা নকশা,    কৃষি সামগ্রী
প্রানী-নকশা,          সাজঘর সামগ্রী,রান্নাঘর সামগ্রী
পালকি নকশা,       মৎস নকশা,     নৌকা নকশা
পায়ের ছাপ নকশা,রথ নকশা,        মসজিদ নকশা
স্বস্তিকা নকশা,       জীবনবৃক্ষ নকশা

কাঁথার পাড়
পাড় হলো কাঁথার সীমানার দিকের অংশ। বেশিরভাগ নকশি কাঁথার পাড় আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি শাড়ীর পাড়কেই কাঁথার পাড় বানানো হয়, কখনো নকশা সেলাই করে পাড় বানানো হয়। সাধারণ পাড় গুলো হলোঃ
শামুক পাড়,   চোক পাড়,   অনিয়ত পাড়, 
অন্যান্য পাড়, ঢেউ পাড়,    নক্ষত্র পাড়
ধানের শীষ অথবা খেজুর চারি পাড়
বিছে পাড়,     বেকি পাড়,    বরফি পাড়
চোক পাড়,    তাবিজ পাড়,  মালা পাড়
মই পাড়,       গাট পাড়,       চিক পাড়
নোলক পাড়, মাছ পাড়,      পাঁচ পাড়
বাইশা পাড়,   আনাজ পাড়, শামুক পাড়
অনিয়ত পাড়, গ্রেফি পাড়,  কলম পাড়


কাঁথার ধরন
কাঁথা সাধারণত লেপের মতো মুড়ি দিয়ে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের কাঁথা গুলো হলোঃ
লেপ-কাঁথা - এধরনের কাঁথা আকারে বড় ও মোটা হয়।
শুজনি কাঁথা - লেপ কাঁথার মত বড় আকারের, তবে এই কাঁথা পাতলা হয়।
রূমাল কাঁথা - সাধারণত এক বর্গফুট আকারের হয়ে থাকে।
আসন কাঁথা - বসার কাজে ব্যবহৃত হয়।
বস্তানি বা গাত্রি - ভারী ও মূল্যবান জিনিসপত্র ঢেকে রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়।
দস্তরখান - খাবার সময় মেঝেতে পেতে তার উপরে খাবার ও বাসনপত্র রাখা হয়।
গিলাফ - খাম আকারের এই কাঁথার মধ্যে কোরআন শরীফ রাখা হয়।

বাংলার লোকশিল্প এবং সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে নকশী কাঁথা। আবেগ, বিরহ, 
ভালবাসার জায়গায় সবসময় বাঙ্গালীর আজন্ম সাক্ষি এই নকশী কাঁথা। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন